ইসমাম পারভেজ কনক
যথাযথ গুরুত্ব অনুধাবন না করায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তীব্র পানি সংকট ছড়িয়ে পড়ছে। বিশ্বের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী পানি সংকটে মধ্যে রয়েছে। আর সুপেয় পানির সংকটে আছেন বিশ্বের ৭৬ কোটিরও বেশি মানুষ। এরমধ্যে পানির দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশেও প্রায় আড়াই কোটি মানুষ সুপেয় পানির সংকটে। পানি সংকটের কারণে হুমকির মুখে পড়েছে জীবন-জীবিকা। এমতাবস্থায় পানির যথাযথ গুরুত্ব অনুধাবন করে পানি সমস্যা সমাধানে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন জরুরী বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এমতাবস্থায় ‘ভ্যালুয়িং ওয়াটার’ বা ‘পানির গুরুত্ব অনুধাবন’- এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে আজ ২২ মার্চ বিশ্ব পানি দিবস পালিত হচ্ছে। প্রতি বছরের ন্যায় এবারো বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও দিবসটি উপলক্ষে কর্মসূচী শুরু হয়েছে। তবে করোনা পরিস্থিতির কারণে এ বছর বিশ্ব পানি দিবসের সকল আয়োজন অনলাইনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে শতভাগ নাগরিকের জন্য সুপেয় পানি নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি নিয়ে এই আয়োজন চলছে। কারণ জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)’র ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে ৬ নম্বরটি সুপেয় পানি নিয়ে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সুপেয় পানির প্রাপ্তির সুযোগ বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। জাতিসংঘ পানি অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে ঘোষণা করেছে। কিন্তু জলবায়ুর প্রভাব, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পানির চাহিদা। উন্নত জীবন-যাপনের প্রয়োজনে মানুষের পানির চাহিদা বেড়ে চলেছে। আর এই চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি অপরিকল্পিত ব্যবহার পানি সংকট বাড়িয়ে দিচ্ছে। দেশের উপকূল, পার্বত্য এলাকা, হাওরাঞ্চল, বরেন্দ্র এলাকা, চা বাগান ও দুর্গম এলাকায় পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে বিশ্বে বেড়ে চলেছে পানির চাহিদা। এরপর নানামুখী অপচয় ও হস্তক্ষেপের কারণে অনেক স্থানে সুপেয় পানির উৎস সংকুচিত, দূষিত এবং ধ্বংস হচ্ছে। ফলে সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দিচ্ছে। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে এই সংকট সব থেকে বেশী। ওই এলাকায় গড় হিসেবে ২৫২ জনের জন্য একটি নলকূপ থাকলেও অনেক এলাকায় নলকূপের অস্তিত্ব নেই। সেখানে পুকুর বা অন্য জলাশয়ের উপর নির্ভর করতে হয়। এসকল এলাকায় সিডর, আইলা ও আম্ফানের মতো প্রকৃতিক দূর্যোগের কারণে অনেক জলাশয় নষ্ট হয়েছে। ফলে সুপেয় পানির সংকটও বেড়েছে।
একাধিক গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, খুলনা, বরিশাল, ঝালকাঠি, পিরোজপুরসহ উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ সুপেয় পানির তীব্র সংকটে পড়েছে। জলবায়ুর প্রভাবে সবখানেই লবণজলের আগ্রাসন। উপকূলের মানুষকে ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে গিয়ে এক কলসি পানি কিনে আনতে হয়। বিশুদ্ধ যাচাই-বাছাই তো দূরের কথা, কোনোমতে খাওয়া যায় এমন খাবার পানি জোগাড় করতেই উপকূলের নারীদের দিন কেটে যায়।
একইভাবে দেশের উত্তরের বরেন্দ্র অঞ্চলেও সুপেয় খাবার পানি এখন দ্ষ্প্রুাপ্য। গ্রীষ্মের শুতেই বরেন্দ্র অঞ্চলের গ্রামগুলোতে খাবার পানির সংকটে জীবন-জীবিকা ব্যাহত হয়। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলার অধিকাংশ এলাকা এবং নাটোরসহ বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া ও পাবনা জেলার কিছু অংশ জুড়ে বরেন্দ্র অঞ্চল অবস্থিত। দেশের গড় বৃষ্টিপাত আড়াই হাজার মিলিমিটার হলেও বরেন্দ্র এলাকায় গড় বৃষ্টিপাত এক হাজার মিলিমিটারের মতো। বৃষ্টিপাতে ভূগর্ভস্থ পানির গড় পুনভর্রণের হার দেশে ২৫ শতাংশ হলেও বরেন্দ্র অঞ্চলে মাত্র আট শতাংশ। একযুগ আগেও বরেন্দ্র অঞ্চলে ৬০ থেকে ৯০ ফুট গভীরে পানি পাওয়া গেলেও বর্তমানে ১৬০ ফুটের নিচে না গেলে পানি মিলছে না। ঝুঁকিপূর্ণ এসব এলাকা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪০-৪৫ মিটার উঁচুতে অবস্থান করছে। বরেন্দ্র এলাকার অনেক উপজেলায় পানির অভাবে ফসলের আবাদ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। পানি না পেয়ে এলাকা ছেড়েছে মানুষ।
আর রাজধানী ঢাকায় পানির স্তর ভূপৃষ্ঠ থেকে গড়ে ২১২ ফুট নিচে চলে গেছে বলে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) এক গবেষণা রিপোর্টে উঠে এসেছে। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ঢাকার পানির স্তর সমদ্রপৃষ্ঠের ১৬০ ফুট নিচে নেমে গেছে। এই হিসাবে ঢাকায় পানির স্তর ভূপৃষ্ঠ থেকে গড়ে ২১২ ফুট নিচে অবস্থান করছে। এ অবস্থায় মাটির নিচ থেকে অব্যাহতভাবে পানি তোলা হলে আগামীতে ঢাকার পানিতে সমুদ্রের লবণ পানি চলে আসতে পারে। এভাবে পানির স্তর নিচে নামতে থাকলে একসময় শুধু পানির অভাবেই ঢাকা ছাড়বে মানুষ।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও এশীয়-প্রশান্ত পানি ফোরাম ‘দ্য এশিয়ান ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট আউটলুক-২০২০’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে পানি সংকট ভয়াবহ। এশিয়া ও প্রশান্ত অঞ্চলের ৪৯ দেশের মধ্যে ৩৭ দেশেই পানি সংকট রয়েছে। এর মধ্যে পানি সংকট ভয়াবহ রূপ পেতে চলেছে বাংলাদেশ, ভারত, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও কম্বোডিয়ায়।
আর বিএডিসি’র গ্রাউন্ড ওয়াটার জোনিং ম্যাপ অনুযায়ী, প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে দেশের ৪১ জেলার ১৯২ উপজেলায় তীব্র পানি সংকট দেখা দেয়। দেশের অধিকাংশ এলাকায় মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে দেশের অনেক এলাকায় সুপেয় পানি এক সময়ে সোনার হরিণে পরিণত হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
এ বিষয়ে ফ্রেশওয়াটার একশন নেটওয়ার্ক দক্ষিণ এশিয়া- বাংলাদেশের কনভেনর যোসেফ হালদার কালের কণ্ঠকে বলেন, জাতিসংঘ পানিকে মানুষের অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও, বাংলাদেশে বিষয়টি অধিকার হিসেবে পরিগণিত হয় না। জনসংখ্যার চাপ এবং তা সামাল দিতে উন্নয়ন কাজে পানিকে গুরুত্বের মধ্যে রাখা হয়নি। ফলে পানির সংকট তৈরি হয়েছে। পানি নিয়ে অনেক পরিকল্পনা হলেও যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। পানি সমস্যা সমাধানে আগামীতে সুনির্দ্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন তিনি।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)’র সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান কালের কণ্ঠকে বলেন, রাজধানীর ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ভীতিকর গতিতে নিচে নেমে যাচ্ছে। ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর দূষিত পানি ব্যবহারের অনপুযোগী হওয়ায় ওয়াসা সুপেয় পানির চাহিদার শতকরা ৭৮ ভাগ ৯০০টি গভীর নলকূপের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ থেকে উত্তোলন করছে। নদীর পানি দূষিত হওয়ার অজুহাতে ওয়াসা একের পর এক গভীর নলকূপ বসাচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানি অধিক উত্তোলনের ফলে পানির স্তর প্রতি বছর ১০ ফুট করে নীচে নামছে। এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে আগামী ১৫ বছরের মধ্যে পানির অভাবে ঢাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন