ইসমাম পারভেজ কনক
দরিদ্র মানুষের জন্যে খাদ্য সহায়তা নিশ্চিত না করেই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে দেশব্যাপী ‘কঠোর লকডাউন’ দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, খাদ্য সহায়তা ছাড়া অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কোটি কোটি দরিদ্র মানুষকে ঘরে আটকে রাখা সম্ভব হবে না।
তাই খাদ্য সহায়তা ছাড়া ঘোষিত এই লকডাউন আদৌ কার্যকর করা যাবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সরকারের এ সিদ্ধান্ত ‘যথাযথ’ হয়নি বলে মনে করছেন তারা।
একইসঙ্গে কোভিডের অভিঘাতে আর্থিকভাবে জর্জরিত এসব দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়াতে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক-পেশাজীবী সংগঠন ও শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
বুধবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রজ্ঞাপনে বৃহস্পতিবার ভোর ৬টা থেকে ৭ জুলাই মধ্যরাত পর্যন্ত সর্বাত্মক লকডাউনের কঠোর বিধিনিষেধ জারি করে বলা হয়, এর বাস্তবায়নে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সেনাবাহিনীও মাঠে থাকবে।
এদিন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকেও বলা হয়, জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হলেই তার বিরুদ্ধে মামলা, এমনকি গ্রেপ্তারও করা হতে পারে।
ফলে কার্যত এই লকডাউনে দরিদ্র কর্মজীবী মানুষের জীবিকা নির্বাহের সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে।
অথচ বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) সাম্প্রতিক এক জরিপের ফলাফল বলছে, কোভিডের আঘাতে দেশে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে দুই কোটি ৪৫ লাখ মানুষ।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনার প্রভাবে দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার (আপার পোভার্টি রেট) বেড়ে ৪২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। দেশব্যাপী খানা জরিপের ভিত্তিতে এই তথ্য জানায় সংস্থাটি।
তবে, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল নতুন দরিদ্রের বিষয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের করা জরিপের ফলাফল স্বীকার করেননি।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে গত ২৭ জুন লকডাউনে দরিদ্র, দুস্থ, অসচ্ছল ও কর্মহীন জনগোষ্ঠীকে মানবিক সহায়তা দিতে ৬৪ জেলার অনুকূলে মাত্র ২৩ কোটি ছয় লাখ ৭৫ হাজার টাকা ছাড় করা হয়। বলা হয়, ৩৩৩ নম্বরে ফোন করলে মানবিক সহায়তা পাওয়ার মতো যোগ্য ব্যক্তিদের এই বরাদ্দ থেকে খাদ্য-সহায়তা দেওয়া হবে।
বুধবার রাজধানীর পুরানা পল্টন মোড়ে এক সমাবেশে ‘কঠোর লকডাউন’ সফল করতে খেতমজুরসহ গ্রামীণ শ্রমজীবী মানুষের খাদ্য সহায়তা ও চিকিৎসা নিশ্চিতের দাবি জানায় ‘ক্ষেতমজুর সমিতি’ নামের একটি সংগঠন।
এ বিষয়ে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সমিতির সভাপতি ফজলুর রহমান বলেন, ‘অতীতে যত লকডাউন হয়েছে তাতে দেখা গেছে “দিন আনা দিন খাওয়া” মানুষ সবচেয়ে বেশি কষ্ট করে। তাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারায় ক্ষুধার তাড়নায় এসব মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে।’
‘ফলে করোনা মহামারি মোকাবিলায় সকল গরিব মানুষদের খাদ্য নিরাপত্তা, রেশনিং ব্যবস্থা চালু, গ্রামের মানুষের করোনা টেস্ট ও ভ্যাকসিন দিতে হবে।’
২০১৬ থেকে ১৭ সালের মধ্যে পরিচালিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ অনুসারে, বাংলাদেশে বিভিন্ন জায়গায় নিয়োজিত শ্রমিকের সংখ্যা ছয় কোটির বেশি। এর মধ্যে ৮৫ দশমিক এক শতাংশই কাজ করেন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। আর অর্থনীতিতে এই খাতের অবদান প্রায় ৫০ শতাংশ।
এ অবস্থায় দেশের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের এসব দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর এই লকডাউনের প্রভাব ও এর কার্যকারিতা প্রসঙ্গে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এবং বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক বিনায়ক সেনের সঙ্গে।
শুরুতেই অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য ন্যূনতম খাদ্য সহায়তা নিশ্চিত না করেই কঠোর লকডাউন আরোপের সিদ্ধান্তের বিষয়ে বলেন, ‘প্রথমত এটা কোনো যৌক্তিক সিদ্ধান্ত না এবং এটা ফলপ্রসূও হবে না। কারণ, লকডাউন কার্যকর করতে গেলে তার পূর্বশর্তগুলো পূরণ করতে হয়।’
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে জাবির এই অধ্যাপক বলেন, ‘যেকোনো দেশেই যদি প্রকৃত অর্থে লকডাউন বাস্তবায়ন করতে হয়, তাহলে এর দ্বারা যারা অ্যাফেক্টেড হবে, তাদের বিষয়গুলো বিবেচনার মধ্যে নিতে হয়। বাংলাদেশে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে পাঁচ কোটিরও বেশি মানুষ কাজ করে। যারা সরাসরি আক্রান্ত। এর বাইরে আমরা যদি দোকান কর্মচারী কিংবা পরিবহন খাতের লোকজনদের ধরি, তারাও একটা বড় অংশ। অথচ লকডাউন আরোপের ক্ষেত্রে এদের বিষয়টি ধর্তব্যের মধ্যেই আনা হয়নি।’
আনু মুহাম্মদ আরও বলেন, ‘আমি এমন কোনো দেশ দেখিনি, যেখানে প্রণোদনা প্যাকেজ বা অন্যান্য সুবিধা এদের (দরিদ্র জনগোষ্ঠী) টার্গেট করে দেওয়া হয়নি। অথচ বাংলাদেশে এদের সম্পূর্ণ এক্সক্লুড (বাদ রেখে) করে মাঝে মধ্যে টোকেন গিফটের মতো কিছু কর্মসূচি নেওয়ার কথা আমরা শুনেছি। সেগুলোও ঠিকমতো বাস্তবায়িত হয়নি।’
এই অধ্যাপকের অভিমত, ‘বিভিন্ন দেশ লকডাউনে এই শ্রেণির জনগোষ্ঠীকে টিকে থাকার জন্যে কয়েক মাস ধরে সাপোর্ট দিয়ে গেছে। আমাদের দেশেও এটা হলে নিশ্চিত করা যেত যে, তারা ঘর থেকে বের হবে না। এখন কিছু না দিয়েই যদি তাদের ঘরে থাকতে বলা হয়, তখন তা একটা ডেসপারেট সিচুয়েশন তৈরি করে। তখন তারা নানা ধরনের রাস্তা খোঁজে।’
আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘বাংলাদেশে তাদেরকে (দরিদ্র জনগোষ্ঠী) বাদ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের প্যাকেজ ঘোষণা করা হলো, ঋণের ব্যবস্থা করা হলো। সেগুলো বড় ব্যবসায়ীদের জন্য হেল্পফুল হয়েছে। কিন্তু, বিশালসংখ্যক এই জনগোষ্ঠীর জন্যে কিছুই হয়নি। তার ফলে এটা কার্যকরও হচ্ছে না।’
সব মিলিয়ে এই অর্থনীতিবিদের পর্যবেক্ষণ হলো, ‘এই ধরনের ইল্লজিক্যাল (অযৌক্তিক), ইনকনসিসটেন্স (অসংগত) ও কন্ট্রাডিক্টরি (পরস্পরবিরোধী) সব সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণেই লকডাউন কার্যকর হয় না। মানুষ করোনায় যতে অ্যাফেক্টেড হচ্ছে, করোনাকালে ব্যবস্থাপনার অভাব কিংবা ভুল সিদ্ধান্তের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তার চেয়ে বেশি।’
এ বিষয়ে সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের বক্তব্য, ‘লকডাউন মানে মানুষকে ঘরে থাকতে বলা। ঘরে থাকা মানে সে আয়-উপার্জন করতে পারবে না। বিশেষ করে যারা দিন আনে দিন খায়। এখন তাদের যদি খাবারের নিশ্চয়তা না দেওয়া হয়, তাহলে কোনো শক্তি কিংবা হুকুম দ্বারা তাদের ঘরে আটকে রাখা সম্ভব না।’
এই বাম নেতা বলেন, ‘আমাদের দেশে যারা দিন আনে দিন খায়, তাদের সংখ্যা হিসাব করা খুব কঠিন না। যাদের সবার জন্যে এক মাসের খাবার সরবরাহ করতে হলে হয়তো বাজেটের এক শতাংশও লাগত না। এটা সরকার কেন করল না, সেটা বুঝতে পারছি না।’
সেলিম আরও বলেন, ‘এর আগেও সরকারকে বলেছিলাম, মানুষকে বলো যে তোমাদের বের হওয়ার দরকার নেই। তোমাদের খাবারের ব্যবস্থা করা হবে। একটা দুর্নীতিমুক্ত ও শক্তিশালী পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমের মাধ্যমে এটা করা সম্ভব ছিল। এমনকি এ বিষয়ে আমি সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকেও অনুরোধ করেছিলাম।’
এ ছাড়া লকডাউনে দরিদ্র, দুস্থ ও কর্মহীন মানুষের জন্যে ২৩ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রসঙ্গে সেলিমের বক্তব্য, ‘সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, করোনাকালে দুই কোটির বেশি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। এর সঙ্গে যদি আগের সংখ্যা যুক্ত করা হয়, তাহলে কমপক্ষে পাঁচ-ছয় কোটি হবে। সেটা হলে একেক জনের ভাগে চার-পাঁচ টাকার বেশি তো পড়ার কথা না। এটা লোক দেখানো, তামাশার মতো একটা বিষয়।’
অবশ্য লকডাউন ও এর ভেতর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবিকা নির্বাহ প্রসঙ্গে কিছুটা ভিন্ন মত পোষণ করেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন। তিনি বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রে সিচুয়েশনের কারণে সব সময় সবকিছু উইন উইন হয় না। পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, সাময়িক দুর্ভোগ হলেও এক সপ্তাহ না, অন্তত এক মাসের কঠোর লকডাউন দেওয়া উচিত। যাতে আমরা এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে পারি।’
দীর্ঘকাল যাবৎ দারিদ্র, আয়-বৈষম্য ও মানব উন্নয়ন নিয়ে কাজ করে আসা এই গবেষক বলেন, ‘অবস্থা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে গেলে নৈরাজ্য নেমে আসবে। সুশাসনের ঘাটতি হবে। (দরিদ্র জনগোষ্ঠীর) যে সাময়িক কষ্টের কথা বলা হচ্ছে, সন্দেহ নেই সেটা হবেই। সেটা মোকাবিলার জন্য যেসব ব্যবস্থাপত্রের কথা আগে বলা হয়েছিল, সেগুলোই আবার চালু করতে হবে। বিভিন্ন পর্যায়ে জরুরি ভিত্তিতে যাদের রিলিফ দরকার, তাদের সেটা দিতে হবে।’
বিনায়ক সেন মনে করেন, কোভিড পরিস্থিতিতে দারিদ্র্যপীড়িত জনগোষ্ঠীকে সহায়তার জন্যে সুশীল সমাজের পক্ষ থেকেও উদ্যোগ থাকা উচিত। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ বহু আগে আত্মশক্তিতে লিখেছিলেন যে, বিদ্যাদান থেকে অন্নদান, সবকিছুর জন্য আমরা কেন সরকারের মুখাপেক্ষী হইতেছি? কেন আমরা নিজেরা কিছু করছি না?’
এ পর্যায়ে বিনায়ক সেন বলেন, ‘কোভিডকালে গত এক বছরে এনজিওদের তাৎপর্যপূর্ণ একটা কোয়ালিশন দাঁড়িয়েছে কি না, আমাকে দেখান। কিংবা তাৎপর্যপূর্ণভাবে চেম্বার অব কমার্স কিংবা বিত্তশালী লোকরাও তো দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়াননি।’
এই অর্থনীতিবিদের ভাষ্য, ‘নাগরিকদের দেখভাল করার বিষয়টি অবশ্যই সরকারের প্রাথমিক ও প্রধান দায়িত্ব। পাশাপাশি আমাদের সবারও কিছু দায়িত্ব আছে। আমরা যারা সরকারকে অ্যাকাউন্টেবল করতে চাই, সেটার কারণ বুঝি। কিন্তু, বৈষম্যের কারণে যারা বড়লোক হয়েছেন গত ১০ বছরে, কেন আমরা তাদের বলি না— আপনারাও আপনাদের শেয়ার প্রসপারেটি গরিব দেশে কিছুটা ভাগ করে দেন।’
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন