ধর্ষণের উদ্দেশ্যে নয়, একান্তে সময় কাটাতে বাসায় আনুশকাকে ডেকেছিল বলে গণমাধ্যম বরাবর পাঠানো খোলা চিঠিতে অভিযুক্ত দিহানের মা সানজিদা সরকার দাবি করেছেন। তিনি এ ঘটনায় মর্মাহত হয়েছেন জানিয়ে সুষ্ঠু বিচার দাবি করেন।
খোলা চিঠিতে দিহানের মা বলেছেন, গত ৭ জানুয়ারি আমার বাসায় আমার ছেলে দিহান ও ওর বান্ধবী অরনা আমিনের ঘটনায় আমি হতবাক। একজন মা ও নারী হিসেবে এ ধরনের ঘটনা মেনে নেওয়া খুবই কষ্টকর। গত দুদিন আমি কোনো সংবাদমাধ্যমে কথা বলিনি। কারণ, আমি পুরো ঘটনা বোঝার চেষ্টা করেছি। দিহানের বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে আমার ছেলের ধর্ষণ এবং হত্যার উদ্দেশ্য ছিল কি না, তা মা হিসেবে জানার চেষ্টা করেছি। একজন নারী হিসেবে কোনো কিশোরীর অসম্মান হোক বা ধর্ষিত হোক- কখনো চাই না।
৭ জানুয়ারি সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটে আমি আমার অসুস্থ পিতাকে দেখতে যাওয়ার জন্য দিহানকে বাসায় একা রেখে বগুড়ার উদ্দেশে রওনা হই। আমার অন্য ছেলে নিজের কর্মস্থলে ছিল। যমুনা সেতু পার হওয়ার পর দুপুর ২টা ৪৫ মিনিটে প্রাথমিকভাবে জানতে পারি মডার্ন হাসপাতালে দিহানের বান্ধবী মারা গেছে। দিহানকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। দ্রুত ঢাকায় এসে দেখি পুলিশ আমার বাসায়। জানলাম মেয়েটি আমার বাসায় দিহানের সঙ্গে দেখা করতে এসে ধর্ষিত হয়েছে এবং মারা গেছে। মা হিসেবে আরও আগে থেকেই একটু আন্দাজ করতে পেরেছি, আমার ছেলে কোনো একটি সম্পর্কে জড়িয়েছে। কিন্তু কোন মেয়ের সঙ্গে, তা জানা ছিল না। তবে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে মেয়েটির ‘Aurna Amin’ নামের ফেসবুক আইডিতে দিহানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছবি, দিহানকে নিয়ে কবিতা লিখা ইত্যাদি দেখে মনে হলো এই মেয়েটির সঙ্গেই দিহান সম্পর্কে জড়িয়েছে। আমি ধারণা করছি, আমি বাসা থেকে বের হওয়ার পর দিহান মেয়েটির সঙ্গে যোগাযোগ করলে মেয়েটি আমার বাসায় আসে। দিহানের সঙ্গে বিশ্বস্ততার সম্পর্ক ছিল বিধায় মেয়েটি আমার বাসায় এসেছিল। আমি মনে করি, ধর্ষণ বা হত্যার উদ্দেশ্যে দিহান মেয়েটিকে বাসায় ডাকেনি। একজন আরেকজনকে ভালোবাসে। সেই হিসেবে একান্তভাবে সময় কাটানোর জন্যই হয়তো ডেকেছিল। উভয়ের বয়স কম। একজন নাবালিকা এবং আমার ছেলেরও বয়স ১৮ বছর ৭ মাস অর্থাৎ কিশোর। আবেগের বশে উভয়েই শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়েছিল এবং অপরিপক্বতার পরিচয় দিয়েছে। পরবর্তীতে যা হয়েছে তা নিতান্তই দুর্ঘটনা মনে হচ্ছে। আমার ছেলে ধর্ষক বা হত্যাকারী হলে সে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করত কিন্তু সে তা করেনি। সে নিজে গাড়ি করে মেয়েটিকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। মেয়েটির মাকে ফোন করেছে, পুলিশের কাছে ঘটনা স্বীকার করেছে। আমার ছেলে যদি মেয়েটির সঙ্গে অন্যায় করে তাহলে একজন নারী হিসেবে আমিও আমার ছেলের যথাযথ বিচার হোক সেটা চাই।
কিন্তু মেয়েটির ইচ্ছায় শারীরিক সম্পর্ক হয়েছিল কিনা এবং একমাত্র শারীরিক সম্পর্কের কারণেই রক্তক্ষরণ ও মৃত্যু হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে পুলিশ প্রশাসনের ওপর আমি বিশ্বাস রাখতে চাই এবং বিচার বিভাগের ওপর আস্থা রাখতে চাই। বিচারের আগে আমার ছেলেকে ধর্ষক বা হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত না করার জন্য সমাজের সবার প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ফারদিনের পরিবার ও তার বড় ভাই সুপ্ত সরকারের বিরুদ্ধেও স্ত্রীকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। পারিবারিক কলহের জেরে স্ত্রীর মুখে জোর করে বিষ ঢেলে হত্যার অভিযোগে মামলা হয়েছিল সুপ্ত’র বিরুদ্ধে। টাকার বিনিময়ে মামলাটি আপস করেছেন সুপ্ত’র বাবা এমন অভিযোগ রয়েছে। ফারদিনরা তিন ভাই। তাদের বাবা আবদুর রউফ সরকার রাজশাহী জেলার অবসরপ্রাপ্ত সাব রেজিস্ট্রার। রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার রাতুগ্রামে তাদের বাড়ি। এ ছাড়াও জেলার বাগমারা উপজেলার তাহেরপুরে তাদের আরো একটি বাড়ি রয়েছে। রাজশাহী শহরেও আছে দু’টি বাড়ি। এর একটি সাগরপাড়া এলাকায়। আরেকটি বাড়ি মহানগরীর পদ্মা আবাসিক এলাকায়। ঢাকার কলাবাগানে রয়েছে নিজস্ব ফ্ল্যাট। বড় ছেলে সুপ্তকে নিয়ে তার বাবা গ্রামে থাকেন। আর মা সানজিদা সরকারের সঙ্গে ঢাকার বাসায় ফারদিন ও তার মেজো ভাই নিলয় থাকেন। নিলয় একটি ব্যাংকে চাকরি করেন। ২০০৯ সালে সুপ্ত’র স্ত্রী রুনা খানকে হত্যার অভিযোগ উঠেছিল সুপ্ত ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে নিহত রুনার মা বাদী হয়ে থানায় মামলা করেছিলেন। তখন আসামিদের শাস্তির দাবিতে মরদেহ নিয়ে রাজশাহী শহরে মিছিল হয়েছিল। কলাবাগান থানার পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশন) ঠাকুর দাস মালো বলেন, ধর্ষণ এবং হত্যার আগে চেতনানাশক কোনো কিছু খাওয়ানো হয়েছিল কিনা সেজন্য নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। এবং বয়স নির্ধারণের জন্যও তার নমুনা নেয়া হয়েছে। প্রতিবেদন পাওয়া গেলে মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে সুনিশ্চিত হওয়া যাবে।
এর আগে গত ৮ জানুয়ারি দিহান দোষ স্বীকার করে আদালতে জবানবিন্দ দিয়েছে। বর্তমানে দিহান কারাগারে রয়েছে।
মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, গত ৭ জানুয়ারি সকাল আনুমানিক সাড়ে আটটার দিকে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা মা কর্মস্থলের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হয়ে যান। এর এক ঘণ্টা পরে তার বাবাও ব্যবসায়িক কাজে বাসা থেকে বের হয়ে যান। দুপুর পৌনে ১২টার দিকে ওই শিক্ষার্থী তার মাকে ফোন করে কোচিং থেকে পড়ালেখার পেপার্স আনার কথা বলে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন। মামলার একমাত্র আসামি ‘ও’ লেভেল পড়ুয়া শিক্ষার্থী দুপুর আনুমানিক ১টা ১৮ মিনিটে ফোন করে ওই শিক্ষার্থীর মাকে জানান, মেয়েটি তার বাসায় গিয়েছিলেন। হঠাৎ অচেতন হয়ে পড়ায় তাকে আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়েছে। অফিস থেকে বের হয়ে আনুমানিক দুপুর ১টা ৫২ মিনিটে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর মা হাসপাতালে পৌঁছেন। হাসপাতালের কর্মচারীদের মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন, আসামি তার কলাবাগান ডলফিন গলির বাসায় ডেকে নিয়ে মেয়েটিকে ধর্ষণ করেন। প্রচুর রক্তক্ষরণের কারণে অচেতন হয়ে পড়লে বিষয়টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য আসামি নিজেই তাকে আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে নিয়ে যান।
এ ঘটনায় ওই শিক্ষার্থীর এক সহপাঠী ইফতেখার ফারদিন দিহানকে একমাত্র আসামি করে মেয়েটির বাবা ধর্ষণ ও হত্যার মামলা করেন।
মামলার বাদী কিশোরীর বাবা বলেন, আমার মেয়ের স্কুলের বান্ধবীর এক বড় ভাই আছে। দিহানসহ ওই তিন ছেলে তার বন্ধু। ওখান থেকেই আমার মেয়ের সঙ্গে দিহানের পরিচয় বা চেনাজানা। ঘটনার দিন ১২টা ১৯ মিনিটে আমার মেয়ের নম্বর থেকে কল আসে। আমি মিটিংয়ে থাকায় ফোনটা কেটে দিই। তারপর আর ফোন করেনি। তার কিছু সময় পর আমার স্ত্রীর ফোনে কল আসে। ফোন করে আমার মেয়ের অসুস্থতার কথা জানায়। প্রথম ফোনটা না ধরাটাই ছিল আমার সবচেয়ে বড় ভুল।
তিনি বলেন, মনে হয় আমার মেয়েকে যখন জোরজবরদস্তি করা হচ্ছিল তখনই সে আমকে ফোন করেছিল। আমি যদি ফোনটা ধরতে পারতাম বিষয়টা এতদূর গড়াত না। পরে আমাকে না পেয়ে আমার স্ত্রীকে ফোন করা হয়। তবে সেটা হাসপাতাল থেকে নাকি ওই বাসা থেকে এটা আমরা জানি না। হাসপাতালে যাওয়ার পর চিকিৎসকরা আমাকে বলেন, মারা যাওয়ার পর হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে। আমার মনে হয়, এমনও হতে পারে, ও কোচিংয়ে যাচ্ছিল। তখন ওই ছেলেরা রাস্তায় তাকে বাধা দেয়। তখন আমাকে আমার মেয়ে ফোন করে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন